কেন ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্কে যুক্ত হতে চায় ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই?
আপলোড সময় :
২১-০৩-২০২৫ ১২:২৪:১৯ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২১-০৩-২০২৫ ১২:২৪:১৯ অপরাহ্ন
ভারতে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি জোট সরকার আর বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এই মুহূর্তে হাজারটা বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে – কিন্তু বিশেষ একটি ক্ষেত্রে এই দুই নেতারই লক্ষ্য এক, আর সে জন্য তারা দুজনেই সক্রিয়!
এই জিনিসটা আর কিছুই নয় – ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংস্থা স্টারলিঙ্ককে তাদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে আসা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওয়াশিংটন ডিসি-তে গিয়ে ইলন মাস্কের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছিলেন।
তার পর গত সপ্তাহে ভারতের দুই ইন্টারনেট ও টেলিকম জায়ান্ট – এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর ঘোষণা করেছে যে স্টারলিঙ্কের সঙ্গে তাদের সমঝোতা চূড়ান্ত, যার মাধ্যমে ওই সংস্থাটি ভারতে তাদের পরিষেবা দিতে পারবে।
ভারতে স্টারলিঙ্ক কবে আর কীভাবে চালু হবে তা নিয়ে এখনও অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে, তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে এদেশের কমিউনিকেশন খাতে সেটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা হতে চলেছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী মোদী যে দিন আমেরিকায় ইলন মাস্কের সঙ্গে দেখা করেন (১৩ ফেব্রুয়ারি), ঠিক সে দিনই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও মি মাস্কের সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বলেন।
বাংলাদেশে স্টারলিঙ্ক 'লঞ্চ' করার জন্য সেদিন মি মাস্ককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস, ক'দিন পরে তিনি চিঠি লিখে বাংলাদেশ সফরে আসার জন্যও ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানান।
মাত্র ৯০ দিনের ভেতর বাংলাদেশে স্টারলিঙ্কের যাত্রা শুরু করা সম্ভব বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
এরপর স্টারলিঙ্কের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে, সে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন স্থাপন ও আরও নানা অবকাঠামোগত বিষয়ে স্টারলিঙ্কের বোঝাপড়াও সম্পন্ন হয়েছে।
সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশ – দুই প্রতিবেশী দেশেই স্টারলিঙ্কের পরিষেবা পাওয়াটা এখন নেহাত আর কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই দুটো দেশেই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তেও নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য একটি দেশে স্টারলিঙ্ক সার্ভিস কিন্তু ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে – আর সেই দেশটি হলো ভুটান।
বস্তুত ২০২৪-র ডিসেম্বরেই ভুটানে স্টারলিঙ্কের ইন্টারনেট প্ল্যান চালু হয়ে গিয়েছিল, তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ২০২৫-র ফেব্রুয়ারিতে।
এই অঞ্চলের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত বা বাংলাদেশ – যেখানেই স্টারলিঙ্ক আগে চালু হোক, স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবার একটা চাহিদা যে এই দেশগুলোও অনুভব করছে সেই ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। এমনকি গৃহযুদ্ধে দীর্ণ মিয়ানমারও চাইছে তাদের দেশে স্টারলিঙ্ক আসুক।
এখন প্রশ্ন হলো, স্টারলিঙ্ক ভারত বা বাংলাদেশে এলে বাড়তি কী সুবিধা মিলবে? প্রযুক্তিগত সুবিধার বাইরেও কি স্টারলিঙ্ককে এনে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সুবিধা আশা করছে এই দেশগুলো?
স্যাটেলাইট নির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবায় অনুমতি দেওয়ার মানে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা, এই ধরনের আশঙ্কাকেই বা কীভাবে 'অ্যাড্রেস' করা হবে?
সবচেয়ে বড় কথা, এই পরিষেবার খরচ কি আদৌ সাধারণ মানুষের নাগালের ভেতর থাকবে? না কি শুধু ধনী কর্পোরেটরাই স্টারলিঙ্ক 'অ্যাফোর্ড' করতে পারবে?
স্টারলিঙ্ক কী, এর বিশেষত্ব কোথায়?
স্টারলিঙ্ক হলো আসলে একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যেটি অপারেট করে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন এরোস্পেস কোম্পানি স্পেসএক্স।
এই মুহূর্তে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা জুড়ে বিশ্বের শতাধিক দেশে স্টারলিঙ্কের পরিষেবা পাওয়া যায়।
গত বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীকে ঘিরে বিভিন্ন কনস্টেলেশনে এই কোম্পানির প্রায় হাজার সাতেক 'লো-আর্থ অরবিট' (এলইও) স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ আছে – যেগুলোর মাধ্যমে তারা ভূপৃষ্ঠে ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে।
ইলন মাস্ক দাবি করেছেন, মহাকাশে স্টারলিঙ্কের এই 'মেগাকনস্টেলেশন' প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঢেলে সাজানো হবে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা স্টারলিঙ্ক গ্রাহকরা তার সুবিধা পাবেন।
সাবেকি ব্রডব্যান্ড সার্ভিস যেখানে ভূগর্ভস্থ কেবল বা টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল, স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইটগুলো কিন্তু পৃথিবীর বুকে ছোট ছোট 'ইউজার টার্মিনালে'র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে।
যেহেতু এক্ষেত্রে টাওয়ার বসানোর বা মাটির নিচে কেবল পাতার কোনো ঝামেলা নেই, তাই দুর্গম প্রত্যন্ত প্রান্তরে বা গ্রামীণ এলাকাতেও খুব সহজে স্টারলিঙ্কের পরিষেবা পাওয়া সম্ভব। গ্রাহকের কাছে শুধু কোম্পানির ছোট 'ইউজার টার্মিনাল'টি থাকলেই যথেষ্ঠ।
অতি দুর্গম জায়গা থেকেও বেশ সহজে স্ট্রিমিং, ভিডিও কল, অনলাইন গেমিং বা রিমোট ওয়ার্কিং করা যায় বলেই স্টারলিঙ্ক দুনিয়া জুড়ে এত জনপ্রিয় হয়েছে।
তবে বিশ্বে স্টারলিঙ্ক বৃহত্তম স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট প্রোভাইডার হলেও তারা একমাত্র নয় - ওয়ানওয়েব ইউটেলসেট, আমাজনের প্রোজেক্ট কুইপার, ভায়াস্যাট কিংবা হিউজেসনেটের মতো আরও অনেক কোম্পানিই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট পরিষেবা দেয় বা দিতে চলেছে।
ইউটেলসেটে আবার ভারতীয় কোম্পানি এয়ারটেলেরও বিপুল লগ্নি আছে, যদিও তারা এদিকে ভারতে স্টারলিঙ্কের সঙ্গেও সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছে।
গত ১১ই মার্চ যখন এয়ারটেল স্টারলিঙ্কের সঙ্গে তাদের অংশীদারিত্বের কথা ঘোষণা করেছিল, পর্যবেক্ষকরা সেটাকে ভারতের ডিজিটাল কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে একটা 'ক্যু'-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
সুনীল ভারতী মিত্তালের কোম্পানি এয়ারটেল তখন প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছিল, সারা দেশ জুড়ে তাদের যে রিটেল স্টোরের (খুচরো দোকান) বিশাল নেটওয়ার্ক আছে, সেখান থেকেই স্টারলিঙ্ক তাদের নিজস্ব ডিভাইস বিপণন ও বিতরণ করতে পারবে। এর ফলে ভারতে স্টারলিঙ্কের প্রাথমিক বিনিয়োগও অনেক কম করতে হবে।
এই মুহূর্তে ভারতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বাজারে সবচেয়ে বড় 'প্লেয়ার' হলো মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন রিলায়েন্স জিও – যাদের সারা দেশে ১ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি 'কেবল-ওলা' ইন্টারনেট গ্রাহক আছে।
এয়ারটেল-স্টারলিঙ্কের সমঝোতার ফলে জিও যখন বিপাকে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ঠিক তখনই মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর জিও প্ল্যাটফর্মস লিমিটেডও ঘোষণা করে তারাও স্টারলিঙ্কের সঙ্গে অনেকটা একই ধরনের পার্টনারশিপে যাচ্ছে।
ফলে ভারতের প্রধান দুই কমিউনিকেশন জায়ান্ট – ভারতী এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও – উভয় কোম্পানিই এখন ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্কের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গ্রাহকদের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়ার দিন গুনছে।
তবে এই দুটো সমঝোতাই ভারতের রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন সাপেক্ষে হবে বলে জানানো হয়েছে, অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল স্টারলিঙ্ক সে দেশে ব্যবসা করতে পারবে।
ভূরাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত?
আন্তর্জাতিক সাময়িকী 'ই-ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসে' গত মাসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গবেষক এমা গ্যাটি ও মার্ক লিন্ডার স্টারলিঙ্ককে এই সময়ের সবচেয়ে বড় 'জিওপলিটিক্যাল ডিসরাপ্টর' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অর্থাৎ তারা বলছেন, বর্তমান ভূরাজনীতিতে এত বড় উথালপাথাল আর কোনো সংস্থাই ফেলতে পারেনি।
আগামী দিনে স্টারলিঙ্ক জেন-থ্রি স্যাটেলাইটের সাহায্যে যখন ১ টেরাবিট-পার-সেকেন্ড (টিবিপিএস) গতিতে সারা দুনিয়ায় ইন্টারনেট দিতে পারবে – তখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই 'ক্লায়েন্ট স্টেট' বা অধিক ক্ষমতাশালীর ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলেও এই গবেষকরা পূর্বাভাস করেছেন।
ইটালির উদাহরণ দিয়ে তারা বলছেন, এ বছরের গোড়ার দিকে যখন ব্লুমবার্গ খবর করে ইটালি তাদের দেশে স্টারলিঙ্কে ১৫০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে – তখন ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা মহলে রীতিমতো ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে গিয়েছিল!
ওই নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, ইউরোপের নিজস্ব কানেক্টিভিটি প্রকল্প 'আইরিস-টু' যখন অনেক বাধাবিপত্তির পর অবশেষে প্রায় শেষের পথে – তখন সেই ইউরোপেরই একটি বৃহৎ অর্থনীতি যদি সেটাকে ছেড়ে মার্কিন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে আস্থা রাখে তখন তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কতটা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না!
এদিকে গত মাসেও যখন ইউক্রেনের 'রেয়ার আর্থ' খনিজদ্রব্যে অধিকার পাওয়ার জন্য মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখন দরকষাকষির অংশ হিসেবে ইউক্রেন থেকে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা প্রত্যাহার করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে অবকাঠামো এখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত – তাদেরই এখন স্টারলিঙ্ক সবচেয়ে বেশি দরকার!
ফলে ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ককে যে গ্লোবাল জিওপলিটিক্সে একটি নতুন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই পটভূমিতেই ভারত সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে ইলন মাস্কই হলেন আমেরিকার নতুন 'ডিফেন্স কনট্রাক্টর' – বা প্রতিরক্ষা ঠিকাদার!"
তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, এতদিন আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানি সারা দুনিয়ায় অস্ত্রশস্ত্র, সাবমেরিন বা যুদ্ধজাহাজ বেচে তাদের 'ক্লায়েন্ট স্টেট' বানাত – আর এখন ঠিক সেই কাজটাই করা হচ্ছে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা বেচে।
বস্তুত বিশ্বের এমন বহু দেশেই স্টারলিঙ্ক বড় বাজার তৈরি করতে পেরেছে, যেখানে ব্রডব্যান্ড কেবল বা টাওয়ার নেটওয়ার্ক যথেষ্ঠ ভালো – দুর্গম বা প্রত্যন্ত এলাকা ততটা নেই। ফলে আপাতদৃষ্টিতে স্টারলিঙ্কের তেমন চাহিদা থাকার কারণ নেই, কিন্তু তবু সে সব দেশেও তাদের গ্রাহক বাড়ছে।
যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন এর একটা বড় উদাহরণ, যা থেকে বোঝা যায় কোনো দেশে স্টারলিঙ্কের প্রবেশ আসলে যতটা না 'কানেক্টিভিটি' সংক্রান্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি 'স্ট্র্যাটেজিক' সিদ্ধান্ত।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকার নতুন প্রশাসনে ব্যক্তি ইলন মাস্কের সাঙ্ঘাতিক প্রভাব ও ক্ষমতা।
নির্বাচনি প্রচারণার সময় থেকেই তিনি শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডান হাত নন, মি ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসার পর থেকে ইলন মাস্কই প্রশাসনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।
ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এমন একজন সাবেক কূটনীতিবিদের কথায়, "ভারতই বলি বা বাংলাদেশ, কিংবা ধরা যাক থাইল্যান্ড – যারাই ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইবে তারা যে ইলন মাস্ককেও সন্তুষ্ট করতে চাইবেন এর মধ্যে তো কোনো রকেট সায়েন্স নেই!"
ফলে এই সব দেশে স্টারলিঙ্কের আসন্ন প্রবেশের নেপথ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার তাগিদেরও ভূমিকা আছে বলেই অনেকে মনে করছেন।
গত মাসে হোয়াইট হাউসের এক সাংবাদিক সম্মেলনে যখন ইলন মাস্ক ও নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জবাব দেন, "হ্যাঁ, ও (মাস্ক) বোধহয় ভারতে কী সব ব্যবসা-ট্যাবসা করতে চাইছে!"
আবার বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে যখন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ জানতে চাওয়া হয়েছিল নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাতেই ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে কি না, তিনি কিন্তু সরাসরি সেটা মানতে চাননি।
ওই সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "না, এটা মূলত ছিল স্টারলিঙ্ক নিয়ে … ব্যবসায়িক সম্পর্কের একটা বিষয় ছিল। সে বিষেয়েই আমরা আলাপ করেছি, যে স্টারলিঙ্কের কানেকশনটা আমরা নিতে চাই।"
জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে?
এয়ারটেল ও জিও-র সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণার পর ভারতে স্টারলিঙ্ক পরিষেবা পাওয়াটা এখন আর অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে ঘটনা হলো, বহু চেষ্টা করেও এতদিন কিন্তু স্টারলিঙ্ক ভারতে ব্যবসা করার অনুমোদন পায়নি।
ভারতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিঙ্ক নিজেদের নথিভুক্ত করেছিল সেই ২০২১ সালের নভেম্বর মাসেই।
এর কয়েক দিন পরেই কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করে, এই কোম্পানি কিন্তু এখনও ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পায়নি – কাজেই সাধারণ মানুষ এদের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করলেই ভালো করবেন।
বস্তুত স্টারলিঙ্ককে নিয়ে ভারতে যাবতীয় সন্দেহ বা অবিশ্বাসের মূলে আছে এই প্রশ্নটাই – এই স্যাটেলইট-নির্ভর পরিষেবা জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে না তো?
দিল্লিতে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওই বিশেষজ্ঞর কথায়, "ঠিক যে কারণে টিকটক-সহ অনেকগুলো চীনা অ্যাপকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বলতে পারেন অনেকটা একই কারণে স্টারলিঙ্ককে এতদিন এ দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।"
এর মাঝে গত ডিসেম্বরেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের কর্মকর্তারা জানান, মাদকবিরোধী একটি অভিযানে গিয়ে তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্টারলিঙ্কের ডিভাইস উদ্ধার করেছেন।
কয়েক সপ্তাহ পরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর থেকে খবর আসে, সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী পাচার করে আনা স্টারলিঙ্ক ডিভাইস ব্যবহার করছে।
মণিপুরে উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্রের যে ছবি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী প্রকাশ করেছিল, তাতে একটি স্টারলিঙ্কের ডিভাইসও দেখা যায়।
এক্স হ্যান্ডলে সেই ছবির জবাব দিয়ে ইলন মাস্ক অতঃপর লেখেন, "এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভারতের আকাশে স্টাররিঙ্কের স্যাটেলাইট বিম সুইচ অফ করা আছে।"
তবে যে কোনো কারণেই হোক, স্টারলিঙ্ককে ঘিরে ভারতের সরকারি মহলে সন্দেহ ও সংশয় আপাতত অনেকটাই কেটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
"এর একটা কারণ হতে পারে স্টারলিঙ্ক ভারতে তাদের যন্ত্রপাতি কিন্তু নিজেরা বেচবে না, এগুলো বিলি করা হবে এয়ারেটল ও জিও-র মতো দুটো ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে। ভারতে স্টারলিঙ্কের নিজস্ব কোনো গ্রাহকও থাকবে না, এরা হবেন ওই দুটি কোম্পানির গ্রাহক।"
"আমি অনুমান করছি স্টারলিঙ্কের ডিভাইসে এখানে একটা কোনো বাড়তি সফটওয়্যার যোগ করা হবে, যাতে ডেটা মনিটরিং করার একটা সুযোগ থাকে। এটা যদিও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তবে হতেই পারে সেই কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেছে", বিবিসিকে বলছিলেন দিল্লির একজন নামী ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ কিন্তু সে দেশে স্টারলিঙ্ক আনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলছে – এর মাধ্যমে মুক্ত ইন্টারনেটের অধিকারই আরও জোরালো হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ভবিষ্যতে সরকারগুলো যাতে কোনো অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই স্টারলিঙ্ককে বাংলাদেশে ডাকা হয়েছে।
তিনি আরও লেখেন, "বাংলাদেশে স্টারলিঙ্কের আসার অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতে এ দেশে কোনো সরকার ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারবে না। অন্তত নতুন কোনো ইন্টারনেট বন্ধের চেষ্টার আঘাত বিপিও ফার্ম, কল সেন্টার ও ফ্রিল্যান্সারদের ওপর আসবে না।"
তবে সম্প্রতি ইউক্রেনে আমেরিকার হুমকির মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা দেশে স্টারলিঙ্কের থাকা না-থাকা শুধু সে দেশের সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না – আমেরিকাও সেখানে অবধারিত প্রভাব খাটাতে চাইবে।
স্টারলিঙ্ক পরিষেবার খরচ কেমন পড়বে?
তবে যাবতীয় ভূরাজনৈতিক বা নিরাপত্তাগত কচকচির বাইরে গিয়ে ভারত বা বাংলাদেশের সাধারণ একজন গ্রাহক হয়তো সবার আগে জানতে চাইবেন, স্টারলিঙ্ক পরিষেবা নিতে চাইলে খরচ কত হবে? সেটা কি আদৌ আমার বাজেটের নাগালে হবে?
এক কথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন – কারণ এই বাজারগুলোতে স্টারলিঙ্কের 'প্রাইস পয়েন্ট' ঠিক কী হবে সেটা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি, আর তা ছাড়া বিশ্বের এক একটা বাজারে তাদের পরিষেবার খরচও এক এক রকম।
বিশ্বের যে একশোটিরও বেশি দেশে স্টারলিঙ্ক এখন চালু আছে, সেখানে তাদের মান্থলি সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানগুলোর খরচ ১০ ডলার থেকে শুরু করে ৫০০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আফ্রিকায় খরচ অনেক কম, ইউরোপে তুলনায় অনেক বেশি। তবে এটি আনলিমিটেড নয়।
এর সঙ্গে এককালীন খরচ দিয়ে স্টারলিঙ্কের হার্ডওয়্যারও (ডিভাইস) গ্রাহককে কিনতে হয়, যার খরচ ২৫০ ডলার থেকে ৩৮০ ডলারের মতো পড়ে।
সেই জায়গায় তুলনা করলে দেখা যাবে ভারতের টেলিকম কোম্পানিগুলো অনেক সস্তায় 'হোম ব্রডব্যান্ড' প্ল্যান অফার করে থাকে, যার খরচ মাসে মাত্র ৫ ডলার (৪৫০ রুপি) বা ৭ ডলার (৬০০ রুপি) থেকে শুরু। হাইস্পিড প্রিমিয়াম প্ল্যানের খরচ অবশ্য চার বা পাঁচ হাজার রুপিও হতে পারে।
তার ওপর স্টারলিঙ্কের ডেটা ব্যবহারে একটা ঊর্ধ্বসীমা আছে, কিন্তু ভারতে রিলায়েন্স জিও বা এয়ারটেলের বেশির ভাগ প্ল্যানই 'আনলিমিটেড'।
ফলে ভারতের মতো একটি 'প্রাইস-সেনসিটিভ' বা দাম-সচেতন বাজারে সফল হতে গেলে স্টারলিঙ্ককে খুবই প্রতিযোগিতামূলক দামে প্ল্যান অফার করতে হবে। তবে এই বাজারে প্রবেশ করাটাই যদি তাদের মূল লক্ষ্য হয়, ব্যবসা বাড়ানো নয় – তাহলে অন্য কথা।
যেমন আফ্রিকার যে ১৬টি দেশে এই মুহূর্তে স্টারলিঙ্ক চালু আছে, তার মধ্যে ৫টিতেই আবার তাদের মান্থলি সাবস্ক্রিপশনের খরচ সে দেশের প্রধান ফিক্সড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের তুলনায় কম।
হিমালয়ের কোলে ভুটানে স্টারলিঙ্ক সদ্যই পরিষেবা চালু করেছে – সেখানে আবার রয়েছে তাদের দুটি প্ল্যান।
'রেসিডেনশিয়াল লাইট' প্ল্যানের খরচ মাসে ৩০০০ ন্যু (৩০০০ রুপি), কিন্তু তাতে অফুরন্ত ডেটা ব্যবহারের সুযোগ নেই। 'স্ট্যান্ডার্ড' প্ল্যান নিলে আবার মাসে ৪২০০ ন্যু (৪২০০ রুপি) দিয়েই গ্রাহক আনলিমিটেড ইউসেজ পাবেন।
সোজা কথায়, দামের ক্ষেত্রে স্টারলিঙ্ক এক এক দেশে পরিস্থিতি অনুযায়ী এক এক ধরনের মডেল ব্যবহার করে থাকে।
ভারতে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এদেশে স্টারলিঙ্কের খরচ প্রতিষ্ঠিত টেলিকম জায়ান্টদের তুলনায় অনেকটাই বেশি হবে, স্টারলিঙ্কের ডেটা স্পিডও কম থাকবে।
অন্যভাবে বললে, এ দেশের দুর্গম ও 'আন্ডারসার্ভড' (যেখানে কেবল বা টাওয়ার নেই) এলাকাগুলোতে পৌঁছানোই হবে স্টারলিঙ্কের প্রধান লক্ষ্য – জিও বা এয়ারটেলের ব্রডব্যান্ড সার্ভিসকে তারা সেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স